• রোববার ০৭ জুলাই ২০২৪ ||

  • আষাঢ় ২৩ ১৪৩১

  • || ২৯ জ্বিলহজ্জ ১৪৪৫

সম্পর্ককে নতুন রূপ দিতে চায় ঢাকা-বেইজিং

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ৪ জুলাই ২০২৪  

২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সর্বোচ্চ স্তর কৌশলগত অংশীদারিত্বে উন্নীত হয়েছিল। এ সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে চায় বাংলাদেশ ও চীন। তাই উন্নয়ন অংশীদারিত্বের মাধ্যমে পারস্পরিক রাজনৈতিক নির্ভরশীলতাকে নতুন রূপ দিতে চায় দুই দেশ। ঢাকা ও বেইজিংয়ের কূটনৈতিক সূত্রগুলো থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ৮ জুলাই চার দিনের সফরে চীন যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরই মধ্যে বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বা এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) মতো চীনের বেশ কিছু বৈশ্বিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশীদার হয়েছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর সফরে ঢাকা আরও কিছু বৈশ্বিক কার্যক্রমে যুক্ত হবে বলে আশা করে বেইজিং। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক কিছু মৌলিক নীতির ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, নিজ জাতীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে একে অপরকে সম্মান ও সহযোগিতা করা, সেই সঙ্গে একে অপরের মূল স্বার্থের জায়গাকে সম্মান করা ও সহযোগিতা করা। একে অপরের প্রধান উদ্বেগের জায়গাগুলোও সম্মান করা। এ বিষয়গুলোতে দুই দেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, চীনের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ ও উদ্বেগের জায়গাগুলো উপেক্ষা করে বাংলাদেশ কিছু করবে না। তবে কৌশলগত কারণে ঢাকা চাইলেই চীনের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ককে গভীর করাকে দৃশ্যমান করতে পারবে না। ফলে উন্নয়ন অংশীদারিত্ব যত বাড়বে, দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাও তত বাড়বে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরের যৌথ বিবৃতিতেও এর প্রতিফলন থাকবে। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরের মধ্য দিয়ে এ সম্পর্ককে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে আগ্রহী দুই দেশ। দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে স্বাগতিক দেশের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিসহ সংশ্লিষ্ট নানা সরকারি দলিলের খসড়া তৈরি করা হয়। এবারের সফরে চীন যে খসড়া যৌথ বিবৃতি তৈরি করেছে, তাতে সম্পর্কের আরও উন্নতি হিসেবে ‘নিবিড় কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের’ প্রস্তাব দিয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে পশ্চিমা বলয় প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে প্রবল আগ্রহ রয়েছে পশ্চিমা বলয়ের দেশগুলোর। তারা ইতোমধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করেছে চীন বাংলাদেশ এ অঞ্চল নিয়ে পরবর্তী কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সফরের দিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখছে পশ্চিমা দেশগুলো। চীন সফরে কী হতে যাচ্ছে তা জানতে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বলে সূত্র জানায়। তাদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর থেকে ভারতের অগ্রাধিকারের একটি চিত্র পাওয়া গেছে। চীনের সফরে কী কী ধরনের চুক্তি হচ্ছে বা কী কী ঘোষণা আসছে, তা থেকে চীনের অগ্রাধিকারের চিত্র পাওয়া যাবে। শক্তিশালী একটি পশ্চিমা দেশের কূটনীতিক নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে বলেন, চীনকে বোঝা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দেশটির উত্থান-পতনের সঙ্গে আমাদের নিজ দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতি জড়িত। আর বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক দিক থেকে যেহেতু কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে, ফলে এখানে চীন নতুন কী করতে যাচ্ছে তা থেকে চীনের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যাবে। দুই দেশের চাওয়া-পাওয়া বিশ্বের অনেক দেশ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাসহ ডলার সংকটের কারণে বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করে আসছে গত বছর থেকে। বাংলাদেশও বেশ কয়েকটি দেশের সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেনে আগ্রহ দেখিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ঢাকা ও বেইজিং দুই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যে সরাসরি লেনদেন নিষ্পত্তি চালুর জন্য আলোচনা এগিয়ে নিয়েছে। পিপলস ব্যাংক অব চায়নায় একটি হিসাব খোলার বিষয়ে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বার্তা প্রেরণের মাধ্যম সুইফটের বিকল্প হিসেবে চীনের সিআইপিএসে যুক্ত হয়ে এ লেনদেন করা হবে। এ নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিনিধি দল গত ২ জুলাই চীন গেছে বলে জানা গেছে। বেইজিং চায় ঢাকা চীনের বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগে (জিডিআই) যুক্ত হোক। এ জন্য ঢাকাকে একটি খসড়াও দিয়েছে তারা। প্রস্তাবটি সক্রিয়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে এ-সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে। দক্ষিণাঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। এরই মধ্যে বন্দরটির কিছু অংশ চালু হলেও পায়রা সমুদ্রবন্দর ঘিরে যে মহাপরিকল্পনা রয়েছে, তার বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। ফলে পায়রাকে ঘিরে ওই অঞ্চলের উন্নয়নে চীনকে অংশীদার হিসেবে পাশে চায় বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে পটুয়াখালীতে নবম বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু নির্মাণ করছে দেশটি। আর অঞ্চলটি চলতি বছরের এপ্রিলে গিয়ে সরেজমিন দেখে এসেছেন ঢাকার চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ সহায়তা একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের চীন সফর উপলক্ষে অর্থ-সংক্রান্ত বড় ধরনের সহায়তা আশা করছে বাংলাদেশ। তিন ধরনের সহযোগিতা নিয়ে যোগাযোগ চলছে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সরাসরি অর্থ সহায়তা, বাজেট সহায়তা ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ সহায়তা। এর মধ্যে রয়েছে উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে ৫ বিলিয়ন ডলার, বাজেট সহায়তা বাবদ ৫ বিলিয়ন ডলার এবং রিজার্ভ সহায়তা বাবদ আরও ২ বিলিয়ন ডলার। নাম না প্রকাশের শর্তে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, তিন ধরনের সহায়তার বিষয়ে চীনা পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে কোনো কিছুই এখনও চূড়ান্ত নয়। দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের আগে কোনো কিছুই আসলে নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে জানতে চাইলে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) এশিয়া উইংয়ের প্রধান মিরানা মাহরুখ সমকালকে বলেন, রিজার্ভ সহায়তা চাওয়ার তথ্য সঠিক নয়। প্রকল্প সহায়তা নিয়েই এখন পর্যন্ত কথা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে কী পরিমাণ ঋণ সহায়তা চাওয়া হবে, তাও এখনও নির্ধারিত হয়নি। কতটি প্রকল্পকে চীনা ঋণের আওতায় আনা হবে, সেটা নিয়ে কাজ চলছে। সুতরাং প্রকল্প সংখ্যা নির্ধারিত হওয়ার আগে ঋণের পরিমাণও সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, এ নিয়ে চীনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে বিষয়টি চূড়ান্ত হবে। এদিকে চীনের কাছ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ চীনা মুদ্রায় পাওয়ার বিষয়ে ঢাকা সফররত চীনের এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গতকাল বুধবার বৈঠক করেছে ইআরডি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই ধরনের বাণিজ্য সহায়তা কিংবা বাজেট সহায়তা অন্য দেশ বা সংস্থা থেকে নিলে সুদের হার কত, রেয়াতকাল, মেয়াদ কত বছর, এসব তথ্য জানানো হয়। চীনের মুদ্রা ইউয়ানে ঋণ নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের আদলে একটি তহবিল গঠন করা হতে পারে। সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের চীন থেকে আমদানির বিপরীতে ইউয়ানে অর্থ পরিশোধ করা হবে। ইআরডির সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় নতুন মেট্রোরেল প্রকল্প নির্মাণে অর্থায়নে আগ্রহের কথা জানায় চীনা পক্ষ। ৬০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে ৪৫ হাজার কোটি টাকার মতো দেবে চীনের এক্সিম ব্যাংক। সভায় ৯টি প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়। মেট্রোরেল ছাড়াও ভাঙা থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের প্রকল্পেও চীনের আগ্রহ বেশি। প্রকল্পটিতে ৪১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে। এ ছাড়া পিরোজপুরে কচা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ এবং মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতু মেরামতে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে অর্থ পেতে চায় বাংলাদেশ। চীনা ঋণ পেতে রেলের আরও যেসব প্রকল্পের তালিকা করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে– গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত মিশ্র গেজ রেলপথ নির্মাণ, পাবনার ঢালারচর থেকে ফরিদপুরের পাচুরিয়া পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ, রাজবাড়ীতে একটি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নির্মাণ এবং ভৈরববাজার থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত মিটারগেজ লাইন মিশ্র গেজে রূপান্তর। ইআরডির তথ্য মতে, গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বহুপক্ষীয় এবং দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে বাংলাদেশের মোট ঋণের স্থিতিতে চীনের অবস্থান চতুর্থ। ঋণের পরিমাণ ৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশের মোট ঋণের ৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। বাংলাদেশের মোট ঋণ স্থিতি ৬২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। চীন সরকার সাধারণত দুই ধরনের ঋণ দিয়ে থাকে। মার্কিন ডলারে প্রেফারেনশিয়াল বায়ার্স ক্রেডিট (পিবিসি) ও চীনের নিজস্ব মুদ্রায় গভর্নমেন্ট কনসেশনাল লোন (জিসিএল) বা সরকারিভাবে দেওয়া রেয়াতি ঋণ। ইআরডির তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালের অক্টোবরে ঢাকা সফরকালে চীনের প্রেসিডেন্ট ২০ বিলিয়ন বা ২ হাজার কোটি ডলার প্রকল্প সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন। সফরে মোট ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নে ওই ঋণ সহায়তার কথা বলা হয়। তখন ৪ বছরের মধ্যে প্রতিশ্রুত অর্থ পাওয়ার কথা বলা হয়। তবে দুটি প্রকল্প পরে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। গত ৮ বছরে চীন থেকে ৮ বিলিয়ন ডলারের মতো সহায়তা পাওয়া গেছে। প্রতিশ্রুত ২৭ প্রকল্পের মধ্যে মাত্র ৯ প্রকল্পের বিপরীতে এ সহায়তা পাওয়া গেছে। প্রতিশ্রুত অর্থ না পাওয়ার পেছনে দুই দেশের আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে দায়ী করা হচ্ছে। এ ছাড়া আসন্ন শীর্ষ বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সমুদ্রকেন্দ্রিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রহ্মপুত্র নদের তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ, বিআরআইকে এগিয়ে নিতে দিকনির্দেশনা, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ), বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, জলবায়ু, পরিবর্তন, ডিজিটাল ও স্বাস্থ্য সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো আলেচনায় আসতে পারে।

দৈনিক জামালপুর
দৈনিক জামালপুর