• বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ||

  • আশ্বিন ২ ১৪৩১

  • || ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সর্বশেষ:

পোশাক শিল্পে ধারাবাহিক বিপর্যয়ের নেপথ্যে

দৈনিক জামালপুর

প্রকাশিত: ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪  

বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি পোশাক শিল্প ঘিরে অসন্তোষ উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। গত ৫ আগস্টের পর থেকে মজুরি ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের পুনর্বহাল, চাকরি প্রত্যাশীদের নিয়োগ, নারী-পুরুষ সমান হারে নিয়োগসহ নানা দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভ-সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে। এ অবস্থায় ঘটে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ। তারা শ্রমিকদের ভিড়ে মিশে গিয়ে বেশকিছু কারখানায় হামলা-ভাঙচুর করছে। শ্রমিকদের মারধর করছে। আগুন দিচ্ছে। এ অবস্থায় ঢাকার অদূরে সাভার ও গাজীপুরে কয়েকশ’ কারাখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার ও প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা এই সমস্যা সমাধানে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। শ্রমিকদের বকেয়া বেতন বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যেই পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
মালিকপক্ষও যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার অনুরোধ জানাচ্ছে। সহিংসতায় জড়িতদের গ্রেফতারসহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপরও প্রতিদিন বিভিন্ন স্থানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে বহিরাগতরা। ফলে স্বাভাবিক হচ্ছে না পোশাক খাত।

অস্থিতিশীল পরিবেশে বন্ধ অনেক কারখানা, ব্যাহত উৎপাদন:
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিরূপ পরিস্থিতির কারণে বেশ কিছুদিন ধরে আশুলিয়া, সাভার ও টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় ১১৯টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষের আলোচনায় কোনো সমাধানে পৌঁছাতে না পারায় গত মঙ্গলবারও ৪০টি কারখানা বন্ধ ছিল। এদিন কয়েকটি পোশাক কারখানায় কর্মবিরতিও পালন করেছেন শ্রমিকরা। বুধবারও আশুলিয়ায় কমপক্ষে ৭০টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

বহিরাগতরা শ্রমিকদের ভিড়ে মিশে গিয়ে বেশকিছু কারখানায় হামলা-ভাঙচুর করছে। শ্রমিকদের মারধর করছে। আগুন দিচ্ছে। এ অবস্থায় ঢাকার অদূরে সাভার ও গাজীপুরে কয়েকশ’ কারাখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

পোশাক শিল্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে কিছু বিদেশি ক্রেতা নতুন করে অর্ডার দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণ নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। চলমান অস্থিরতার কারণে সামগ্রিকভাবে পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

একেক জায়গায় একেক দাবি, অধিকাংশই নতুন:
আশুলিয়ার শারমিন গ্রুপের শ্রমিকরা কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে ২০টি দাবি তুলে ধরে। এসব দাবির বেশিরভাগই এ শিল্পে একেবারে নতুন। যেমন শ্রমিক মারা গেলে কোম্পানির দায়িত্বে গ্রামের বাড়িতে মরদেহ পাঠাতে হবে, চাকরিরত কেউ অসুস্থ হলে তার চিকিৎসার খরচ কোম্পানিকে বহন করতে হবে, মাতৃত্বকালীন ছুটির টাকা আগেই দিতে হবে।

নরসিংহপুরের নাসা গ্রুপে জমা দেওয়া ১৫টি দাবির তালিকায় আছে- বার্ষিক বেতন ১০ শতাংশ বৃদ্ধি, ঈদে ১২ দিন করে ছুটি। এই শিল্পে এর আগে কখনো এমন দাবি তোলা হয়নি।

জিএবি লিমিটেডের শ্রমিকরা কারখানার খাবারে সপ্তাহে দুই দিন গরুর মাংস, দুই দিন মুরগির মাংস এবং দুইদিন সবজির সঙ্গে ডিম দেওয়ার দাবি তুলেছে। পাশাপাশি জ্বর, মাথাব্যথার মতো সমস্যায় চিকিৎসা ও ওষুধ দিয়ে একদিনের ছুটি, বছরে একবার পিকনিকে নিয়ে যাওয়া, কমপক্ষে ১০ বছরের চাকরির নিশ্চয়তা চাওয়া হয়েছে।

বিরূপ পরিস্থিতির কারণে বেশ কিছুদিন ধরে আশুলিয়া, সাভার ও টঙ্গীসহ বিভিন্ন এলাকায় ১১৯টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। শ্রমিকদের সঙ্গে মালিকপক্ষের আলোচনায় কোনো সমাধানে পৌঁছাতে না পারায় গত মঙ্গলবারও ৪০টি কারখানা বন্ধ ছিল। এদিন কয়েকটি পোশাক কারখানায় কর্মবিরতিও পালন করেছেন শ্রমিকরা। বুধবারও আশুলিয়ায় কমপক্ষে ৭০টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

রাজনৈতিক দলসহ বহিরাগতদের বিরুদ্ধে ইন্ধন-উসকানির অভিযোগ:
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ৫ আগস্টের পর সাভার ও আশুলিয়ার পোশাক কারখানার ঝুট, ক্যাটারিং এবং টিফিন ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাদের দলের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৭০ শতাংশ কারখানা এখন বিএনপি নেতারা দখলে নিয়েছেন। অন্যান্য কারখানা পুরোপুরি দখলে নেয়ার উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের বিক্ষোভে উসকানি দেওয়া হচ্ছে। বাইরের লোকজনের মাধ্যমে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর ঘটানো হচ্ছে, এমনকি সড়ক অবরোধও করা হচ্ছে।

অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উসকানিদাতা ছাত্রলীগ নেতা গ্রেফতার:
পোশাক কারখানায় নাশকতার মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উসকানিদাতা ছাত্রলীগ নেতা ইসতিয়াক আহম্মেদ হৃদয়কে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত রোববার রাতে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নেত্রকোণার কেন্দুয়া থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি ছাত্রলীগের সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের শিক্ষা ও পাঠ্যক্রমবিষয়ক সম্পাদক। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোশাকশ্রমিকদের উদ্দেশে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে ভাইরাল হন ছাত্রলীগ নেতা ইসতিয়াক আহম্মেদ হৃদয়়।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মজুরি, টিফিন ভাতা, হাজিরা বোনাস এবং বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু হঠাৎ তৃতীয় পক্ষ ঢুকে বিভিন্ন কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চালাচ্ছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তাদের দলের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ৭০ শতাংশ কারখানা এখন বিএনপি নেতারা দখলে নিয়েছেন। অন্যান্য কারখানা পুরোপুরি দখলে নেয়ার উদ্দেশ্যে শ্রমিকদের বিক্ষোভে উসকানি দেওয়া হচ্ছে। বাইরের লোকজনের মাধ্যমে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর ঘটানো হচ্ছে, এমনকি সড়ক অবরোধও করা হচ্ছে।

এসব উসকানিতে তৃতীয় পক্ষ কাজ করছে: পোশাক শিল্প মালিক
পোশাক শিল্প মালিকরা বলেন, আন্দোলনে শ্রমিকরা অংশ নিচ্ছে না। এসব উসকানিতে তৃতীয় পক্ষের হাত রয়েছে। এ খাতে আধিপত্য বিস্তারে বিএনপি-ছাত্রলীগসহ বহিরাগতরা এসে ইন্ধন দিচ্ছে, ভাঙচুর ও সহিংসতা সৃষ্টি করছে। একেক কারখানার সামনে একেক ধরনের দাবিতে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। কেউ কেউ সুনির্দিষ্ট দাবির পরিবর্তে অযৌক্তিক দাবির দিকে ঝুঁকে পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করছে।

বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা:
তৈরি পোশাক খাতে চলমান এমন অস্থিরতা নিয়ে শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরাও। তাদের মতে, দেশের পোশাক খাত নিয়ে দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র সক্রিয় রয়েছে। এ সংকট দ্রুত সমাধান করা সম্ভব না হলে দেশের পুরো পোশাক শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। রফতানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ও পোশাকশিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতিদিন বিপুল অংকের ক্ষতি হয়েছে। সেসব ক্ষতি কাটিয়ে উঠে এ শিল্প ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। তখনই নতুন করে অসন্তোষ শুরু হয়। শ্রমিক অসন্তোষের নেপথ্যে বহিরাগতদের ইন্ধনের অভিযোগ রয়েছে। ইন্ধনদাতাদের দ্রুত খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।

শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা মজুরি, টিফিন ভাতা, হাজিরা বোনাস এবং বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিক্ষোভ করেছে। কিন্তু হঠাৎ তৃতীয় পক্ষ ঢুকে বিভিন্ন কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চালাচ্ছে।

বর্তমান সরকারকে সমস্যায় ফেলতে ষড়যন্ত্র হচ্ছে: শ্রমিক নেতা নাজমা
শ্রমিক নেতা নাজমা আক্তার ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, দেশের গার্মেন্টস সেক্টরে এ অস্থিরতার জন্য দুটি বিষয় কাজ করছে। একটি হচ্ছে- রাজনৈতিক বিষয়। অপরটি হচ্ছে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার। আমি মনে করি- যারা ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন, ক্ষমতা হারিয়েছেন আসলে তারা বসে নেই। তারা বর্তমান সরকারকে নানাভাবে সমস্যায় ফেলতে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। বর্তমান সরকার যেন ভালোভাবে কাজ করতে না পারেন সেজন্য সেসব লোক গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা তৈরি করছে। তারা মনে করে- গার্মেন্টস সেক্টরে প্রায় ৩৪ লাখ লোক কাজ করে। এই বিপুলসংখ্যক লোককে যদি ক্ষেপিয়ে তোলা যায় তবে সরকার সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। এজন্য একটি অসাধু চক্র গার্মেন্টস সেক্টরকে বেছে নিয়েছে।

তিনি বলেন, গার্মেন্টস সেক্টরে অপর যে বিষয়টি কাজ করে তা হচ্ছে শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার। কারণ, সেক্টরের শ্রমিকরা বছরের পর বছর নানাভাবে বঞ্চিত হয়ে আসছে। এ বঞ্চনা থেকে শ্রমিকরা সাম্প্রতিক সময়ে গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা তৈরি করছে বলে আমি মনে করি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার যদি যথাযথভাবে আদায় করা যায়, তাহলে গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা কমে আসবে এবং শ্রমিকরা কাজে ফিরে যাবে।

প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো গার্মেন্টস সেক্টর ধ্বংস করতে চায়: আব্দুল কাদের খান
গার্মেন্টস অ্যাক্সেসরিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আব্দুল কাদের খান ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, সরকার পতনের সাথে সাথে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো গার্মেন্ট সেক্টর ধ্বংস করার জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো চায়- আমাদের এখান থেকে কাজের অর্ডার তাদের দেশে চলে যাক। গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা তৈরির মাধ্যমে আমাদের সুনাম নষ্ট করার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে।

তৈরি পোশাক খাতে চলমান এমন অস্থিরতা নিয়ে শঙ্কিত বিশেষজ্ঞরাও। তাদের মতে, দেশের পোশাক খাত নিয়ে দেশি-বিদেশি গভীর ষড়যন্ত্র সক্রিয় রয়েছে। এ সংকট দ্রুত সমাধান করা সম্ভব না হলে দেশের পুরো পোশাক শিল্পে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। রফতানিমুখী এ শিল্পকে বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

সরকারের উচিত কঠোর হাতে দমন করা: ব্যবসায়ী নেতা শহিদুল্লাহ
বিজিএমইয়ের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বর্তমান পরিচালক শহিদুল্লাহ আজিম ডেইলি বাংলাদেশকে বলেন, বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কিছু মহল গার্মেন্ট সেক্টরকে অস্থির করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তারা আসলে দেশের গার্মেন্টস সেক্টর নষ্ট করার জন্য এসব কাজ করে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে ভেঙে দেওয়ার জন্য তারা চেষ্টা করছে। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত এসব ব্যক্তিকে কঠোর হাতে দমন করা।

দৈনিক জামালপুর